চোরাকারবারী ধরে পুলিশে দেওয়ায় উল্টো চাঁদাবাজির মামলায় ফাঁসলেন আটককারীরা
শেরপুর জেলা প্রতিনিধি: চোরাই পথে আনা ভারতীয় কসমেটিকস পাচারকারী চক্রের দুই সদস্যকে পিকআপসহ আটক করে পুলিশে সোপর্দ করার পর আটকের সময় ভারতীয় মালামাল সঙ্গে না থাকায় মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পায় চোরাকারবারীরা। তবে পুলিশে দেওয়ার পরদিন উল্টো চোরাকারবারীদের দায়ের করা মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলার আসামি করা হয়েছে আটককারী ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপি নেতাদের। এ ঘটনায় রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষোভ দেখা দিয়েছে বিএনপি, ছাত্রদলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলো দিয়ে ব্যাপকহারে চোরাচালান বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে, উপজেলার পশ্চিম সমশ্চুড়া, রঞ্জনা ঝর্ণা, কালিস্থান, শ্যুটিং খোল, বুরুঙ্গা ১০ নাম্বার, বুরুঙ্গা কালাপানি, বুরুঙ্গা পোড়াবাড়ি, খলচান্দা কোচপল্লী, দাওধারা, পানিহাতা ফেকামারী এলাকা দিয়ে ভারতীয় গরু, ভারতীয় জিরা, কম্বল ও কসমেটিকস এবং ভারতীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের বড় বড় চালান আসতে শুরু করে। ইতিমধ্যেই পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর হাতে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় চালান জব্দ হয়েছে। এসব চোরাচালানে জড়িতরা যে কটি রুট ব্যবহার করে তার মধ্যে নন্নী বাজার একটি।
গত ২৬ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) রাত সাড়ে দশটার দিকে পিকআপে করে নন্নী বাজার হয়ে কসমেটিকসের একটি চালান শেরপুর শহরের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় নন্নী বাজারে থাকা যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা ওই পিকআপকে থামতে সংকেত দেন। কিন্তু পিকআপটি বেপরোয়া গতিতে চলে যায়। এরপর তিনানী বাজারে সংকেত দিলেও থামানো যায়নি। একপর্যায়ে পথিমধ্যে ভারতীয় চোরাই মালামাল পিকআপ থেকে গোপন কোথাও নামিয়ে সামনে গেলে বাজিতখিলা এলাকায় তা আটকা পড়ে। পরে ওই পিকআপটি নন্নী বাজারে আনা হয়।
খবর পেয়ে চোরাকারবারের সাথে জড়িত পশ্চিম সমশ্চুড়া গ্রামের সাদ্দাম হোসেন, হাবিবুর রহমান, হাফিজুর রহমান ও ইছহাকসহ কয়েকজন নন্নী বাজারে আসে। এখানে আসামাত্রই ছাত্র ও যুব নেতারা তাদের ঘিরে ফেলে এবং পিকআপে পাচার করা মালামাল সম্পর্কে জানতে চায়। উপস্থিত লোকজনের উত্তম-মধ্যমের শিকার হয়ে একপর্যায়ে ভারতীয় কসমেটিকস পাচারের কথা স্বীকার করে সাদ্দাম ও হাবিবুর। একই সাথে ওইসব মালামাল জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নিয়ামুল হাসান আনন্দের বলে জানায়। পাচারকারী সাদ্দাম আরও জানায় যে, মালামালগুলো পিকআপ চালক কোথায় নামিয়ে রেখেছে তা সে জানে না। এমনকি চালককে ডেকে সেগুলো আনার কথা জানিয়ে এমন ভুল আর করবে না বলেও কথা দেয়।
এদিকে খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে স্থানীয় নন্নী ইউপি সদস্য আব্দুল্লাহ, পোড়াগাঁও ইউপি সদস্য ফারুক ও অন্যান্য লোকজনের সামনে পিকআপসহ চোরাকারবারের সাথে জড়িত আটককৃত সাদ্দাম হোসেন ও হাবিবুর রহমানকে গভীর রাতে থানায় নিয়ে আসে। তবে চোরাই মালামাল জব্দ না হওয়ার কারণ দেখিয়ে মুচলেকা নিয়ে পরদিন শুক্রবার তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
ছাড়া পেয়ে সাদ্দাম ও হাবিবুর শেরপুর শহরের একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে কয়েকজন সাংবাদিকের সামনে সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ওইসব মালামাল জেলা ছাত্রদল সভাপতি নিয়ামুল হাসান আনন্দের ছিল না। এরপর শনিবার চোরাকারবারের সাথে জড়িত হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে (১। মোঃ শাহিন আলম (৩২), পিতা- শামস উদ্দিন, সাং- নন্নী ঢেকরাপাড়া ২। মোঃ ইমরান (৩৫), পিতা- সিরাজুল সরকার, সাং- পোড়াগাঁও ৩। মোঃ ফারুক (৩৬), পিতা- আবুল কালাম মেম্বার, সাং- নন্নী পশ্চিমপাড়া ৪। মোঃ রাসেল সরকার (৩৩), পিতা- মৃত মহসিন, সাং- নন্নী মাঠখোলা ৫। মোঃ কামাল (৩৫), পিতা- নূর হোসেন, সাং- নন্নী ঢেকরাপাড়া ৬। মোঃ হাবিবুর রহমান (৩৪), পিতা- অজ্ঞাত, সাং- নন্নী বাইগড়পাড়া ৭। মোঃ উজ্জল (৩৮), পিতা- মৃত মোজা, সাং- নন্নী মাঠখোলা ৮। মোঃ বিল্লাল (৩৭), পিতা- অজ্ঞাত, সাং- নন্নী উত্তরবন্দ ৯। মোঃ রাসু (৩৫), পিতা- মৃত রহিজল হাজী, সাং- নন্নী উত্তরবন্ধ, সর্ব থানা-নালিতাবাড়ী, জেলা-শেরপুর সহ আরো অজ্ঞাতনামা ৮/১০ জন) বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের মোট ৯ জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে উল্টো মামলা দায়ের করে। মামলাটি তাৎক্ষণিক এফআইআরভুক্ত করে পুলিশ।
এদিকে চোরাকারবারের সাথে জড়িতদের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় যুব ও ছাত্র নেতাদের আসামি করায় বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় যুবদল, ছাত্রদল ও বিএনপি নেতাদের মাঝে।
এ বিষয়ে নন্নী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মাহবুবুর রহমান রিটন জানান, "যারা চোরাকারবারি করেছে, তাদের কিছুই হলো না। অথচ যারা তাদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করল, তাদের বিরুদ্ধেই চোরাকারবারিরা মিথ্যা মামলা দিল। আর পুলিশ কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই সেই মামলা এফআইআর করল। বিষয়টি অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমরা সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এ ঘটনার ন্যায্য বিচার দাবি করছি।"
তিনি আরও বলেন, "প্রশাসনের কাছে আমার প্রশ্ন, সাধারণ জনগণের চেয়ে কি চোরাকারবারিদের হাতই বেশি শক্তিশালী?"
উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক নুরুল আমীন জানান, চোরাকারবারী ধরায় বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদল নেতাদের বিরুদ্ধে উল্টো মিথ্যা মামলার বিষয়টি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই এবং সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।
সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার নালিতাবাড়ী সার্কেল দিদারুল ইসলাম জানান, যে কেউ মামলা দিতে পারে। তবে তদন্ত করে এর সত্যতা যাচাই করা হবে।
What's Your Reaction?