বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অফগ্রিড সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন মনপুরায়।

এশিয়ার সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র।

Sep 2, 2024 - 04:30
Sep 2, 2024 - 04:49
 0  16
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অফগ্রিড সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন মনপুরায়।

 মো: শাহিন চরফ্যাশন প্রতিনিধি :

ভোলার মনপুরা উপজেলায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় অফগ্রিড সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। চলতি বছরেই এ কেন্দ্র থেকে কম দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবে দূর্গম দ্বীপের প্রায় ৯০ হাজার বাসিন্দা। দেশের অফগ্রিড এলাকায় অর্থাৎ যেখানে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নেওয়া সম্ভব না সেখানে বিদ্যুৎ বিতরণে তিন ধাপের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। দেশের মোট ভূখন্ডের শতকরা মাত্র এক ভাগ হলেও আরইবিতে এমন এলাকার গ্রাহক রয়েছেন আড়াই লাখের মতো। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই তাদের বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানান আরইবি সংশ্লিষ্টরা। এতে মনপুরার মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা সেবার উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ করে পর্যটন খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্টার্ণ মনপুরা সোলার পাওয়ার লিমিটেড এই দ্বীপে সোলার-ব্যাটারি-ডিজেল হাইব্রিড বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এ অফগ্রিড সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দিনের বেলায় ৩ মেগাওয়াট এসি বিদ্যুৎ সরাসরি ব্যবহার করা হবে। বাকিটা ব্যাটারিতে সঞ্চিত থাকবে। এজন্য স্থাপন করা হবে বিশাল আকারের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যাংক। রাতে কিংবা কুয়াশায় সূর্যের আলো না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সঞ্চিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাবে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় টানা কয়েক দিন বৃষ্টি অথবা কুয়াশার কারণে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যাহত হলে তখন বিকল্প হিসেবে ডিজেল জেনারেটর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা সরবরাহ করা হবে। কেন্দ্রটি থেকে ২০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ কিনতে চুক্তি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো)। বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাছ থেকে ২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনে ভর্তুকি দিয়ে কম দামে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে। এতে বিদ্যুতের দাম পড়বে আবাসিকে গড়ে ৬ টাকা। আর বাণিজ্যিকে দাম হবে গড়ে সাড়ে ১২ টাকা। অথচ এখন সোলার মিনিগ্রেড বা জেনারেটরের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম এখন নেয়া হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা। প্রকল্প পরিচালক এবং ওজোপাডিকোর নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং জ্বালানি দক্ষতা সেলের প্রধান প্রকৌশলী মতিউর রহমান বলেন, মনপুরার বাসিন্দাদের জন্যই অফগ্রিড সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হলে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় এবং এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় অফগ্রিড বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, সরাসরি জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত না থাকার কারণে দুর্যোগ কিংবা বড় ধরনের সংকট ছাড়া সেখানে কোনো লোডশেডিং থাকবে না। মনপুরার বাসিন্দাদের জন্যই কেন্দ্রটি নির্মাণ করার কারণে দেশের অন্যান্য এলাকায় কোনো কারণে বিদ্যুৎ না থাকলেও সেখানকার বাসিন্দারা বিদ্যুৎ পাবেন। প্রকৌশলী মতিউর বলেন, মনপুরা থেকে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডের দূরত্ব প্রায় ৯৬ কিলোমিটার হওয়ায় সরাসরি গ্রিড লাইন নির্মাণের সুযোগ নেই। তবে নদী কিংবা সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবল স্থাপন করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেত। এতে সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হতো। পরিবেশে বান্ধব এ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের বিপুল এই অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। ভবিষ্যতে ভোলার চরফ্যাশনে গ্রিড সাবস্টেশন তৈরি করা হলে সেখান থেকে গ্রিড লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে এ প্রকল্পে। সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, মনপুরায় প্রায় ৯০ হাজার মানুষের বসবাস। বর্তমানে জেনারেটরের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ওজোপাডিকো। শুরুতে চারটি জেনারেটর থাকলেও এখন দুটি জেনারেটরের মাধ্যমে সন্ধ্যা থেকে মাত্র দুই/তিন ঘণ্টা সেখানকার ৮৫৩ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি ২ হাজার ৩০৩ জন গ্রাহক বেসরকারি খাতের সোলার মিনিগ্রিডের সাহায্যে বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন। এজন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য গ্রাহককে সব মিলে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা খরচ করতে হয়। আরও কিছু মানুষ তাদের বাড়িতে নিজস্ব উদ্যোগে ছোট সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। এ বিদ্যুতের জন্য মানুষকে অনেক বেশি ব্যয় করতে হয়। তাছাড়া এ বিদ্যুৎ তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে পান না। নতুন এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ওজোপাডিকো প্রায় ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিতরণ লাইন তৈরি করছে। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যবহারের কারণে ব্যয় কিছুটা বাড়লেও পরিবেশ ও সামগ্রিক বিবেচনায় এটি লাভজনক। মনপুরার পাশাপাশি ঢালচর, কলাতলির চর ও কাজিরচরে এ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য ভ্রমণকারীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় মনপুরা দ্বীপ। প্রকৃতির অপূর্ব রূপ এখানে বিচ্ছুরিত হয়। পূর্বাকাশের সূর্যোদয় আর নীল আকাশের পশ্চিম প্রান্তে সাগরের বুকে সূর্যাস্থ দেখার জন্য মনপুরায় ঘুরতে আসে লোকজন। প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পদের বৈচিত্রে ভরপুর মনপুরা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ প্রধান বাধা হয়ে রয়েছে। কয়েকশ বছরের পুরনো এ দ্বীপের বেশিরভাগ শিশুর পড়াশোনার ক্ষেত্রে কুপিবাতিই আজও ভরসা। উপযুক্ত বিদ্যুতের অভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেকসে অস্ত্রোপচার, এক্স-রেসহ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার কাজে ব্যাঘাত ঘটে। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার তেমন একটা হয়নি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হলে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি ওই এলাকার সামগ্রিক উন্নয়ন হবে বলে মনে করছেন স্থানীরা।  জনগনের কন্ঠ.কম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow