স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণে বাধা কোথায়
ডা. আ ফ ম খালেদ হোসেন । ২৩ জুলাই ২০২৩, আপডেট ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
মোঃ আনোয়ার উল্যাহ শরিফ
উপজেলা প্রতিনিধি চরফ্যাশন
উপসম্পাদকীয়
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণে বাধা কোথায়
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ২৩ জুলাই ২০২৩, ১৯:১৮, আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৩, ০৫:৫২
এদেশে ব্রিটিশরা আসার বহু আগে থেকেই মুসলিম শিশুদের শিক্ষা ও ধর্মীয় মানস গঠনে চালু রয়েছে আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা মক্তব বা ফোরকানিয়া মাদরাসা নামে পরিচিত ছিল। এসব পাঠশালা এখন ইবতেদায়ি মাদরাসা নামে পরিচিত। এই পাঠশালাগুলো থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষার্থীরা দ্বীনী তালিম হাসিলে মাদরাসায় ভর্তি হয়। বর্তমানে ইবতেদায়ি মাদরাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সমাজ, ভ‚গোল পাঠ্যভুক্ত থাকায় যেকোনো শিশুর হাইস্কুলেও ভর্তির সুযোগ আছে। এক কথায় ইবতেদায়ি মাদরাসার উপযোগিতা বহুমুখী। আফসোসের কথা, ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা যুগ যুগ ধরে অবহেলিত। মাদরাসাগুলোও অবকাঠামোগত সুযোগ-সবিধা থেকে বঞ্চিত। মাঝে মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দাবিদাওয়া মানার আশ্বাস দেয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সরকারের অভ্যন্তরে থাকা একটি মহলের অনীহায় সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যায়নি।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা নীতিমালা-২০১৮, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮-এর ঘোষণা, বাংলাদেশের সাংবিধান প্রদত্ত অধিকার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার- এসবের কোনো কিছুই ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের ভাগ্য বদলাতে পারেনি। ১৯৭৮ সালের মাদরাসা শিক্ষা অধ্যাদেশ-১৯৭৮-এর ১৭(২) (বি) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জনসাধারণের দানে পরিচালিত ফোরকানিয়া মাদরাসাগুলো বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ১৯৮৩ সালের ২৫ আগস্ট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা নামকরণ করে। পরবর্তী বছর ১৯৮৪ সালে মঞ্জুরি দেয়। এরপর ১৭ নভেম্বর ২০০৮ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড নতুন করে পাঠদানের অনুমতি দেয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে ১৫ বছর ধরে বাদ পড়া বা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত ইবতেদায়ি মাদরাসা সরকার থেকে পাঠদানের অনুমতি পায়নি। ১৫ বছর আগে পাঠদানের অনুমতি পাওয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার সংখ্যা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের হিসাবে ছয় হাজার ৮৮১টি। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, সাত হাজার ৫১টি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের হিসাবে আট হাজার ৯৫৬টি। এর মধ্যে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার সংখ্যা এক হাজার ৫১৯টি। এ যাবৎকালে প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান হিসেবে শুধু ১৯৮৭ সালে তৎকালীন সরকার মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত প্রায় প্রতিটি মাদরাসাকে দুই কিস্তিতে এককালীন চার হাজার ২০০ টাকা ও পরবর্তী কিস্তিতে সাত হাজার টাকা করে মোট ১১ হাজার ২০০ টাকা দেয়। অনুমোদন দেয়ার চার বছর পর মাদরাসা উন্নয়নে ১১ হাজার ২০০ টাকা দেয়া এক ধরনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শামিল। ১৯৯৪ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের অধীনে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের অনুদান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে যাচাইয়ের বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে ৬৪ জেলার চার হাজারের মধ্য থেকে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসাকে অনুদানভুক্ত করে শিক্ষকদের মাসিক ৫০০ টাকা হারে অনুদান দেয়া হয়।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পরও প্রায় ৯ হাজার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষক বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে বহু বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও সম্মতিকে সরকারের কোনো অংশ বাধাগ্রস্ত করছে তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আনজুমানে আল ইসলাহর সভাপতি মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী, ইসলামী শিক্ষা উন্নয়ন বাংলাদেশের সভাপতি ড. এ কে এম মাহবুবুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে এক লাখ ৩০ হাজার প্রাইমারি স্কুল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে। এ ছাড়াও এনজিও পরিচালিত হাজার হাজার স্কুল উপজেলা প্রশাসন থেকে কোড নম্বর নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ ও বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। অথচ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ছয় হাজার ৮৮২টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় কমপক্ষে ৩০ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের আওতায় নেয়া জরুরি।
একই দেশে ডিগ্রি ও মাস্টার্স ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রাইমারি হেড মাস্টার ও শিক্ষকরা যে কারিকুলাম ও সিলেবাস অনুসরণে পাঠদান করছেন, ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধানরা ফাজিল (ডিগ্রি) ও কামিল (মাস্টার্স ডিগ্রি) সনদ নিয়ে একই কারিকুলাম ও সিলেবাসে পাঠদান করছেন। উপরন্তু মাদরাসার স্বকীয় চারটি অতিরিক্ত বিষয় পাঠদান করে যাচ্ছেন। অথচ ইবতেদায়ি প্রধান একজন অফিস সহকারীর সমান বেতন পাচ্ছেন। একই দেশে এমন বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের আন্দোলনের সাথে যুক্ত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহিদুল হক নয়া দিগন্তের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো অর্ধশতাধিক পিটিআই রয়েছে। অথচ সংযুক্ত ও স্বতন্ত্র ১৫ সহস্রাধিক মাদরাসার জন্য ৪৮ বছরেও একজন শিক্ষকের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রাইমারি শিক্ষার উন্নয়নকল্পে প্রাক-প্রাথমিক স্তর রয়েছে। সেখানে শিক্ষক বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ৩৭ হাজার ৬৭২ শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে কাজ করছেন, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু মাদরাসার জন্য এ স্তর খোলার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
৪৫ হাজার ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক তাদের ১১ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন বহুদিন ধরে। ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের দাবি ন্যায্য, যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত। সম্প্রতি তারা এসব দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছেন। সেমিনার ও র্যালি করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস চালাচ্ছেন। অবহেলা, গ্লানি ও আর্থিক দীনতা অশ্রু হয়ে গড়াচ্ছে। শিক্ষকরা অবহেলিত হলে জাতির উন্নয়নগতি বাধাগ্রস্ত হয়।
একটি মুসলিমপ্রধান দেশে ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রতি বৈষম্য শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জাজনকও বটে। স্বাধীনতার ৫২ বছরের মধ্যে কোনো সরকার ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের প্রতি ইনসাফ করেনি। অতি দ্রুত এসব দাবি মেনে নিয়ে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণ করা সময়ের দাবি। স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাহাড়সম বৈষম্য কোনোক্রমে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
জনগণের কন্ঠ.কম
What's Your Reaction?