গারো পাহাড়ে থামছে না মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব

Nov 7, 2024 - 23:30
 0  9
গারো পাহাড়ে থামছে না মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব

তাওহিদুজ্জামান রোমান
বার্তা সম্পাদক, জনগণের কন্ঠ. কম

শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে ধানখেতে জেনারেটরের তারে জড়িয়ে মৃত বন্য হাতিকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। ওই স্থান ঘিরে প্রতি রাতেই অবস্থান করেছে ৫০–৫৫টি বন্য হাতির পাল। হাতির ডাকে এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া আশপাশের ধানখেত নষ্ট করেছে হাতির পাল। এই পরিস্থিতিতে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন গ্রামবাসী।

গত বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) রাতে বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামে ধানখেতে কৃষকদের দেওয়া জেনারেটরের তারে জড়িয়ে একটি বন্য হাতির মৃত্যু হয়। ওই রাতে ২৫–৩০টি হাতি ছিল। শুক্রবার থেকে ওই দলে আরও ২০–২৫টি হাতি যোগ দিয়েছে।

শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান মানুষ ও বন্য হাতির সংঘাত ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করছে। গত এক দশকে হাতির আক্রমণে ৩৫ জনের প্রাণহানি এবং প্রায় ২০০ জন আহত হয়েছেন। বিদ্যুতের ফাঁদ ও অন্যান্য দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৩০টি হাতি।

১৯৯৫ সালে ভারতের মেঘালয় থেকে দলছুট হয়ে আসা একটি হাতির দল গারো পাহাড়ে প্রবেশ করে। একসময় শাল ও গজারি বনের বিস্তৃতি তাদের খাদ্যের প্রাচুর্য সরবরাহ করত, কিন্তু বন উজাড় এবং বসতি গড়ে ওঠার ফলে হাতির প্রাকৃতিক আবাস সংকুচিত হয়ে পড়েছে। খাদ্যের অভাবে হাতিরা লোকালয়ে হানা দিচ্ছে, যা মানুষ ও হাতির সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গারো পাহাড়ে বর্তমানে প্রায় ৬০-৭০টি হাতি বসবাস করছে। ক্ষুধার্ত হাতির দল প্রায়শই ফসল ও বাড়িঘরে আক্রমণ চালাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেছেন, ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল সুরক্ষিত রাখা এবং হাতি চলাচলের এলাকাগুলোতে মানুষের বসতি কমিয়ে মসলা জাতীয় ফসলের চাষ করলে এই সংঘাত কিছুটা কমানো সম্ভব।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, "গারো পাহাড়ের ঝিনাগাতি, শ্রীবর্দী ও হালুয়াঘাট উপজেলায় ২০১৬ সালে ১৩ কিলোমিটার সৌর বেষ্টনী নির্মাণ করা হয়েছে। গোপালপুর ও হালুয়াঘাটে আরও ২ কিলোমিটার সোলার বেড়া নির্মাণ করা হয়েছে এবং বর্তমানে ৮ কিলোমিটার সৌর বেষ্টনী নির্মাণের কাজ চলছে। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ৫০ কিলোমিটার সৌর বেষ্টনী ও বায়োফেন্স নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।"

মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, "ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া না দিলে হাতির আক্রমণ পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হবে না।"

নালিতাবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ছানোয়ার হোসেন বলেন, "এই এলাকায় হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ থানায় এসে হাতির বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি করার পর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তারা ক্ষতিপূরণও পান। তবে স্থায়ী সমাধান এখনও অধরা।"

স্থানীয় আদিবাসী নেতা লুইস নেংমিনজা বলেন, "বনে খাবারের অভাব হওয়ায় হাতিরা লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। এর ফলে মানুষকে চরম ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।"

মানুষ ও হাতির দীর্ঘমেয়াদী এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow