ধান পাকেনি, তবু হাতির ভয়ে আধাপাকা ধান কাটছেন পাহাড়ি কৃষকরা

তাওহিদুজ্জামান রোমান
শেরপুর জেলা প্রতিনিধি | জনগণের কন্ঠ
শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে ফসলি মাঠে নেমে আসা বন্যহাতির তাণ্ডবে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। রাতের পর রাত নির্ঘুম পাহারা দিয়েও রক্ষা করতে পারছেন না সোনার ফসল। বাধ্য হয়ে সময়ের অনেক আগেই আধাপাকা ধান কেটে নিচ্ছেন তারা—মনের ভেতর আশঙ্কা আর চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে।
পাহাড়ঘেঁষা পোড়াগাঁও, নয়াবিল ও রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকায় গত এক মাস ধরে বন্যহাতির অবিরাম হামলায় চাষিরা দিশেহারা। প্রতিদিন বিকেলের দিকে ৪০-৫০টি হাতির একটি দল খাদ্যের সন্ধানে মাঠে নেমে আসে। ধানক্ষেতের পাকা ও আধাপাকা ধান খেয়ে এবং পায়ে মাড়িয়ে শেষ করে দেয় কৃষকের বছরের সাধনার ফসল।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) সরেজমিনে পোড়াগাঁও ইউনিয়নের আন্ধারুপাড়া ও বুরুঙ্গা কালাপানি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের ঢালে কৃষক-কৃষাণীরা আতঙ্কিত মুখে দল বেঁধে তড়িঘড়ি করে আধাপাকা ধান কেটে নিচ্ছেন। কারও চোখে ক্লান্তি, কারও মুখে শঙ্কার ছাপ।
আন্ধারুপাড়া গ্রামের কৃষক সুবাস মাংসাং বলেন, "৫০ শতাংশ জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছিলাম। হাতির দল রাতের পর রাত আমার ধান লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে আধাপাকা অবস্থায় ধান কেটে নিচ্ছি, না হয় পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। পেট চালানো আর দেনা শোধ করার ভরসা ছিল এই ফসলেই। এখন সেটা নিয়েই টানাটানি।"
কৃষক আবু হানিফ জানান, "হাতির দল আসবে এই ভয়ে ধান পুরো পাকার অপেক্ষা না করে কাটতে বাধ্য হচ্ছি। সারারাত মশাল জ্বালিয়ে আর হাঁকডাক করে হাতি তাড়াতে হয়। ঘুম আসে না, আবার সকালে উঠে ধান কাটতে মাঠে যেতে হয়। শরীর ভেঙে যাচ্ছে, তবু কিছু করার নেই।"
কৃষাণী বানেছা বেগম চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, "আগে হাতিরা রাতে আসতো, এখন দিনে-রাতেও ভয় নেই ওদের। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়েও সারারাত জেগে থাকি। কখন যে দুর্ঘটনা ঘটে, কে জানে! হাতির ভয় আর ফসলের দুশ্চিন্তায় আমাদের এখন দিন-রাত এক হয়ে গেছে।"
এ বিষয়ে মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা দেওয়ান আলী বলেন, "ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিধি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, ৮০ শতাংশ ধান না পাকা পর্যন্ত সাধারণত কাটার পরামর্শ দেওয়া হয় না। তবে বন্যহাতির ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় ৬০ শতাংশ পাকা হলে কৃষকদের দ্রুত ধান কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, যাতে অন্তত ন্যূনতম খোরাকি আর উৎপাদন খরচের টাকা উঠে আসে।"
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আক্তার ববি বলেন, “গারো পাহাড়ি এলাকায় বন্যহাতির তাণ্ডব একটি জাতীয় সমস্যা। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তাছাড়া বন বিভাগের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে এবং হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে সচেতনতামূলক সভাও করা হচ্ছে।”
What's Your Reaction?






