ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিধবার জমি দখল: ভুয়া দলিল ও ভূমিদস্যুর তাণ্ডব

Dec 20, 2024 - 10:03
 0  9
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিধবার জমি দখল: ভুয়া দলিল ও ভূমিদস্যুর তাণ্ডব

নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি: ভুয়া মালিক বানিয়ে জাল দলিল তৈরি করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের এক বিধবার ৪৬ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছে আব্দুল মান্নান ওরফে কেওরা মান্নান নামে এক ভূমিদস্যু। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের ডালুকোনা দাওধারা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শুধু তাই নয়, জসপিনা নেংমিনজা নামে ওই বিধবা এবং তার সন্তানদের প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকিতে রেখেছে আব্দুল মান্নান ও তার সন্তানেরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নয়াবিল ইউনিয়নের ডালুকোনা মৌজার বর্তমান ২৪নং খতিয়ানে ও ১১৪নং দাগে ৪৬ শতক জমির প্রকৃত রেকর্ডীয় মালিক ছিলেন প্রবাসু কোচ। ষাটের দশকে প্রথমে গ্রাম্য দলিলে ও ১৯৬৩ সালের ৪ জুলাই প্রবাসু কোচ ওই জমি স্থানীয় তাজিমনি সাংমার কাছে রেজিস্ট্রি দলিলে বিক্রি করে ভারতে চলে যান। তাজিমনির উত্তরাধিকার সূত্রে ওই জমির পরবর্তী মালিক হন তারই কন্যা জসিন্তা সাংমা। ১৯৯৯ সালের ১২ এপ্রিল জসিন্তা সাংমা ওই জমি তার আপন ভাগ্নি জসপিনা নেংমিনজাকে সাব-রেজিস্ট্রি করে লিখে দেন। তবে নিজেদের ভোগদখলে থাকায় তাজিমনি, জসিন্তা ও জসপিনা নিজেদের নামে রেকর্ড বা নামজারি করাননি। আর এ দুর্বলতার সুযোগ নেন আব্দুল মান্নান ওরফে কেওরা মান্নান। ২০১১ সালের ৬ জানুয়ারি ঝিনাইগাতি উপজেলার নকশি গ্রামের গোপাল কোচকে প্রবাসু কোচ বানিয়ে ডালুকোনা গ্রামের চরিত্র সরকারের নামে ভুয়া দলিল তৈরি করেন আব্দুল মান্নান। পরবর্তীতে চরিত্র সরকার ওরফে চরিত্র হাজং-এর কাছ থেকে ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট ওই জমি নিজের নামে লিখে নেন ভূমিদস্যু মান্নান। আর এ পুরো জালিয়াতির বিষয়টি গোপন রেখে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশ করে ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর ওই জমির নামজারি সম্পন্ন করান কেওরা মান্নান।

এদিকে সহজ-সরল চরিত্র সরকার বিষয়টি বুঝতে পেরে জসপিনাদের কাছে এফিডেভিট করে দিয়ে স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি ওই জমি কারও কাছ থেকে কিনেননি, কারও কাছে বিক্রিও করেননি। আব্দুল মান্নান তাকে ভুল বুঝিয়ে অন্য দাগ নম্বরের কথা বলে এ কাজ করিয়েছে।

কিছুদিন আগে জসপিনার দখলে থাকা ওই জমির তিন শতাধিক গাছের চারা কেটে জোরপূর্বক দখলে নেন আব্দুল মান্নান। পরে ওই জমিতে চাষাবাদ শেষে কয়েকদিন আগে বালু উত্তোলনের জন্য চুক্তিতে বিক্রি করে দেন। এমতাবস্থায় পাহাড়ি টিলা ও ঝিরির পাশে থাকা ওই স্থান থেকে বালু উত্তোলনে নিষেধ করতে গেলে গত বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে অসদাচরণ করে ও তাদের লাঞ্ছিত করে আব্দুল মান্নান ও তার ছেলে-মেয়েরা।

এলাকাবাসী জানান, শুধু জসপিনা নয়, এমন অনেক খ্রিস্টান পরিবারের জমি জালিয়াতি করে দখলে নিয়েছে আব্দুল মান্নান। এমন সব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য আব্দুল মান্নানকে এলাকায় কেওরা মান্নান হিসেবে সবাই চিনেন। এলাকাবাসী আরও জানান, মান্নান অন্যের জমি দখল ছাড়াও অবৈধভাবে বনের গাছ কাটা, পাহাড়ের পাথর ও বালু উত্তোলনসহ নানা অপরাধে জড়িত। তার ছেলেরা চোরাচালানসহ সীমান্তে নানা অপরাধে জড়িত। কিছুদিন আগে চোরাই পথে চোরাকারবার করতে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করায় আব্দুল মান্নানের ছেলে ইমরান বিএসএফ-এর হাতে আটক হয়। পরে সেখানে কারাবাস করে দেশে ফিরে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, চুরি করে বনের গাছ কাটা থেকে শুরু করে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও এর আশপাশ থেকে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন করে বিক্রি করে আব্দুল মান্নান ও তার ছেলেরা।

ভুয়া জমি বিক্রেতা চরিত্র সরকার ওরফে চরিত্র হাজং জানিয়েছেন, আব্দুল মান্নান তাকে ভুলভাল বুঝিয়ে অপরিচিত এক কোচকে এনে ওই কোচকে দিয়ে তার নামে জমি লিখিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন পর আবার তার কাছ থেকে ওই জমি আব্দুল মান্নান লিখে নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমার জন্মের পর প্রবাসু কোচকে দেখিনি। আমি কারও কাছ থেকে ওই জমি কিনিনি, বিক্রিও করিনি। যে জমি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, মূলত ওই জমি জসপিনাদের।

জসপিনার ছেলে রাসেল নেংমিনজা জানান, গত বছরের মাঝামাঝি ওই জমিতে আমরা গাছের চারা লাগিয়েছি। একদিন হঠাৎ সকালে উঠে দেখি, জমির একপাশে আব্দুল মান্নান ঘর তুলে রেখেছে। কিছুদিন আগে আবার ওই জমির চারাগুলো কেটে জোরপূর্বক দখলে নিয়েছে আব্দুল মান্নান।

বিধবা জসপিনা নেংমিনজা জানান, আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এমনিতেই ভয়ে থাকি। তারপরও আমি বিধবা। আব্দুল মান্নান ও তার ছেলে-মেয়েরা ভয়ঙ্কর। আমরা তাদের সাথে পারি না। ভুয়া দলিল করে জোর করে জমি দখলে নিয়েছে। এখন আমাদের হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান মি. লুইস নেংমিনজা জানান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জমি রেজিস্ট্রির বেলায় স্থানীয় ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র প্রদান সাপেক্ষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি নম্বর দলিলে উল্লেখ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু আব্দুল মান্নানের কথিত দলিল পর্যালোচনা করে এমন কোনো নম্বর বা ট্রাইবাল চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে গত মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) ডালুকোনা গ্রামে গেলে আব্দুল মান্নানের ছেলে-মেয়েরা উল্টো অসদাচরণ করে। এ সময় তাদের কাছে বৈধতা দেখতে চাইলে তারা দেখাবে না বলেও জানিয়ে দেয়।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow